মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স পলিসিগুলির প্রকার
প্রিয়জনকে হারানোর থেকে বেদনাদায়ক আর কিছুই হয় না এবং তা যদি তাঁর চিকিৎসার খরচ ব্যয় না করতে পারার কারণে হয়, তাহলে সেটা সবচেয়ে বেশি দুঃখজনক। কষ্টের সময় কেবল আপনজনেরাই পাশে থাকে, তাই না? আপনি শুধু যে এটি শুনেছেন, তাই নয়, বরং জীবনে বহুবার এর অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
চিকিৎসা পরিষেবায় ব্যয়ের বৃদ্ধির কথা মাথায় রাখলে ভারতে হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসিই সর্বোত্তম পথ। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের ইন্স্যুরেন্স পলিসি রয়েছে। আসুন, ভারতে উপলব্ধ বিভিন্ন হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ভারতে 7 প্রকারের হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি
1. ইন্ডিভিজুয়াল হেলথ ইন্স্যুরেন্স
আপনি নিজে, আপনার জীবনসঙ্গী, সন্তান ও বাবা-মাকে কভার করার জন্য একটি ইন্ডিভিজুয়াল হেলথ ইন্স্যুরেন্স কিনতে পারেন। এই ধরনের ইন্স্যুরেন্স পলিসি আপনার আঘাত ও অসুস্থতার কারণে হসপিটালাইজেশনের খরচ, সার্জারির খরচ, রুমের ভাড়া, ডেকেয়ার প্রক্রিয়া ও অন্যান্য বিষয় কভার করে।
ইন্ডিভিজুয়াল হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যানে কভার হওয়া প্রত্যেক সদস্যের ইন্স্যুরেন্সের নিজস্ব অর্থ পরিমাণ থাকবে। যেমন, আপনার জীবনসঙ্গী, 2জন সন্তান ও নিজের জন্য ইন্স্যুরেন্সের 3 লাখ অর্থ পরিমাণের একটি ইন্ডিভিজুয়াল হেলথ পলিসি আপনি নিলে, প্রত্যেক ব্যক্তি ইন্স্যুরেন্সের 3 লাখ অর্থ পরিমাণ দিয়ে কভার হবেন। এর ফলে প্রিমিয়াম তুলনামূলক বেশি হয়।
আপনার মতো কোনও ব্যক্তি, যাঁর বয়স 18 বছর থেকে 70 বছরের মধ্যে, তিনি এই প্ল্যানটি কিনতে পারেন। একটি ইন্ডিভিজুয়াল পলিসি কেনার সবচেয়ে ভাল দিক হল, এটি কভার হওয়া প্রত্যেক সদস্যকে ইন্স্যুরেন্সের নিজস্ব অর্থ পরিমাণের সীমা অফার করে।
2. ফ্যামিলি ফ্লোটার হেলথ ইন্স্যুরেন্স
আপনি যদি আপনার পরিবারের সকল সদস্যের জন্য একটি সাশ্রয়ী হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি চান, তাহলে আপনাকে ফ্যামিলি ফ্লোটার হেলথ ইন্স্যুরেন্স বেছে নিতে হবে।
একটি ফ্যামিলি ফ্লোটার হেলথ ইন্স্যুরেন্সে পলিসিতে কভার হওয়া সব সদস্যের জন্য ইন্স্যুরেন্সের একটি অর্থ পরিমাণ থাকে। ফ্যামিলি ফ্লোটার হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান সুবিধাজনক, কারণ এটির প্রিমিয়াম ইন্ডিভিজুয়াল হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসির তুলনায় কম। এই পলিসি আপনাকে, আপনার জীবনসঙ্গীকে, আপনার সন্তানদের ও বাবা-মাকে কভার করতে পারে।
আপনার পরিবারের 60 বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের সদস্য হিসাবে যোগ না করা উচিত। কারণ তাঁদের অসুস্থতার সম্ভাবনা বেশি এবং তার ফলে প্রিমিয়াম প্রভাবিত হবে।
যদি আপনার বা আপনার পরিবারের বরিষ্ঠ সদস্যের বয়স 60 বছরের কম হয়, তাহলে আপনার ফ্যামিলি ফ্লোটার পলিসি কেনা উচিত।
3. গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স
একসাথে কর্মরত কর্মীদের জন্য গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি তৈরি করা হয়েছে। তাই, যদি আপনি একটি স্টার্ট-আপ বা কর্পোরেট সংস্থার মালিক হন, তাহলে আপনার কর্মীদের জন্য এই ধরনের প্ল্যান কেনা উচিত। এটি কর্মীদের অফার করা এক ধরনের সুবিধা। একজন নিয়োগকর্তা হিসাবে আপনি কর্মী ধরে রাখার হার বৃদ্ধি করার জন্য এই কভার কিনতে পারেন।
গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যানের প্রিমিয়াম খুব কম হয়। কিছু ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ইন্স্যুরেন্সের অর্থ পরিমাণ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে একধিকবারও তা রিফিল করতে দেয়। একটি গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, জটিল অসুস্থতা, মানসিক অসুস্থতা ও মাতৃত্বের জন্য আপনার হসপিটালাইজেশন কভার করে।
একটি গ্রুপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি কিনলে কেবল আপনার কর্মীরাই কভার হবেন না, পাশাপাশি আপনার কোম্পানির সুনামও বৃদ্ধি পাবে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবে যে আপনার কর্মীরা কেবল আপনার কোম্পানিতে কর্মরত থাকাকালীনই কভার হবেন।
4. সিনিয়র সিটিজেন হেলথ ইন্স্যুরেন্স
যে-হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি নির্দিষ্টভাবে 60 বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের জন্যই তৈরি, সেটিকে সিনিয়র সিটিজেন হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান বলা হয়। আপনার বাবা-মা বা ঠাকুরদা-ঠাকুমার বয়স 60 বছরের বেশি হলে, এই কভারটি আপনার জন্য ভাল।
সিনিয়র সিটিজেন পলিসি ওষুধ, দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার জন্য হসপিটালাইজেশন, হসপিটালাইজেশনের আগে ও পরে এবং চিকিৎসার জন্য কভারেজ দেবে। এছাড়াও, অন্যান্য কিছু সুবিধা, যেমন বাড়িতে হাসপাতালের মতো চিকিৎসা ও মানসিক অসুস্থতার সুবিধাও কভার করা হয়।
কিছু ইন্স্যুরেন্স প্রদানকারী সিনিয়র সিটিজেন হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি বিক্রি করার আগে সম্পূর্ণ শরীরের চেক-আপ করতে বলতে পারেন। এই পলিসি নেওয়ার সর্বাধিক বয়স এখন 70 বছর করা হয়েছে এবং এটি সারাজীবন রিনিউ করা যায়। আমরা জানি যে বরিষ্ঠ নাগরিকদের অসুস্থতার সম্ভাবনা অনেক বেশি, সেই কারণে এই প্ল্যানগুলি অন্যান্য হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসিগুলির তুলনায় বেশি খরচসাপেক্ষ।
5. ম্যাটার্নিটি হেলথ ইন্স্যুরেন্স
সাধারণ হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যানের সঙ্গে রাইডার হিসাবে একটি ম্যাটার্নিটি কভার কেনা যায়। গর্ভাবস্থা, প্রসব ও তার পরবর্তী সময়ের সব খরচ কভার করা হয়।
সদ্যবিবাহিত দম্পতি বা যে পরিবার আগামী বছরগুলিতে সন্তানের জন্ম দেওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁদের এই পলিসিটি কেনা উচিত। এটি সন্তানের জন্ম (চিকিৎসাগতভাবে প্রয়োজনীয় গর্ভপাত-সহ), বন্ধ্যাত্বের জন্য খরচ এবং সদ্যজাত শিশুর প্রথম 90 দিন পর্যন্ত খরচ কভার করে। ম্যাটার্নিটি কভারের সর্বনিম্ন অপেক্ষার সময়কাল 2 বছর।
6. ক্রিটিকাল ইলনেস ইন্স্যুরেন্স
আমাদের জীবনযাত্রার কারণে অসুস্থতার সংখ্যা দিন-দিন বাড়ছে। এই কথা মাথায় রেখে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলি ক্রিটিকাল ইলনেস বা গুরুতর অসুস্থতা পলিসি অফার করেছে।
বিশেষত মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা এই হেলথ প্ল্যান যে-রোগগুলি কভার করে, সেগুলি হল:
- ক্যান্সার
- স্ট্রোক
- কিডনি বিকল হওয়া
- পক্ষাঘাত
- করোনারি আর্টারি বাইপাস সার্জারি
- প্রথম হার্ট অ্যাটাক
- পালমোনারি আর্টারিয়াল হাইপারটেনশন
- মাল্টিপল স্কেলেরোসিস
- অ্যাওর্টা গ্রাফট সার্জারি
এই রোগগুলির চিকিৎসা করানো খরচসাপেক্ষ। ক্রিটিকাল ইলনেস প্ল্যানে আপনার রোগ ধরা পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে এটি আপনাকে চিকিৎসার আসল খরচ নির্বিশেষে আগেই একটি অর্থ পরিমাণ দিয়ে দেবে।
ক্রিটিকাল ইলনেস পলিসি কেনার থেকে ভাল আর কিছু হতেই পারে না, কারণ আপনার সঞ্চয়কে প্রভাবিত হতে দেয় না। এই পলিসিটি আজীবন রিনিউ করা যায়। আপনি যদি ক্রিটিকাল ইলনেস পলিসি কেনেন, তাহলে রোগনির্ণয়ের পরে 30 দিন পর্যন্ত আপনার খরচ কভার হওয়া উচিত।
আপনার পরিবারে যদি কোনও রোগ আগে কোনও সদস্যের হয়ে থাকে, তাহলে এই পলিসিটি কেনা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এককালীন অর্থ ছাড়াও ক্রিটিকাল ইলনেস পলিসি যত্ন ও হসপিটালাইজেশনের খরচ রিইম্বার্স করে। আপনি বিনামূল্যে হেলথ চেক-আপের সুবিধাও নিতে পারেন।
কিন্তু আপনাকে মনে রাখতে হবে যে একবার ক্লেম জমা করা হলেই ইন্স্যুরেন্সের অর্থ পরিমাণ এককালীন দিয়ে দেওয়া হয়। ইন্স্যুরেন্সের অর্থ পরিমাণ দিয়ে দেওয়ার পরে পলিসিটি বন্ধ হয়ে যায়।
7. টপ-আপ হেলথ ইন্স্যুরেন্স
আপনি যদি বেশি অর্থের কভারেজ চান, তাহলে টপ-আপ পলিসি কিনতে পারেন। কিন্তু এই ধরনের প্ল্যানে “ডিডাক্টিবল ক্লজ” থাকে। সুতরাং, ক্লেমের ক্ষেত্রে পরিমাণ পলিসিতে উল্লিখিত নির্দিষ্ট সীমার থেকে বেশি হলে তবেই পেমেন্ট করা হবে।
যেমন, আপনি যদি 15 লক্ষের একটি কভার নিয়ে থাকেন এবং সেটির 3 লক্ষ টাকা ডিডাক্টিবল হয়, তাহলে আপনাকে 3 লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্লেমের খরচ দিতে হবে। তার থেকে বেশি খরচ হলে তা ইন্স্যুরেন্স প্রদানকারী দেবে।
সুতরাং, আপনি যদি আপনার সাধারণ হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসির থেকে বেশি ও বিস্তৃত কভার চান, তাহলে আপনি এই প্ল্যানটি কিনতে পারেন।
হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যানগুলিতে আপনি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফার করা একটি দৈনিক নগদ ভাতাও পেতে পারেন। এগুলি হল 30-45 দিনের জন্য রিইম্বার্স করা দৈনিক খরচ এবং এগুলি হসপিটালাইজেশনের খরচের থেকে আলাদা।
হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসির চাহিদা বাড়ার ফলে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও তাদের প্রোডাক্টের সংখ্যাও বেড়েছে। চিকিৎসার খরচ দিন-দিন বাড়ছে, তাই উপরের পলিসিগুলির মধ্যে কোনও একটি কিনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
হেলথ ইন্স্যুরেন্স থাকা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আপনি অল্প বয়স থেকেই সম্ভবত হেলথ ইন্স্যুরেন্স কিনে নেওয়ার বিষয়ে অনেক কিছু পড়েছেন ও শুনেছেন। কম বয়সে হেলথ প্ল্যান কেনার সুবিধা রয়েছে, কারণ কম বয়সে আপনার রোগের সম্ভাবনা কম থাকায় আপনি ওয়েটিং পিরিয়ড বা অপেক্ষার সময়কাল কাটানো থেকে বেঁচে যান, আপনি ভাল পরিমাণে কিউমিউলেটিভ বোনাস পান এবং যত বছর যায়, আপনি নিজের ইন্স্যুরেন্সের অর্থ পরিমাণ বাড়াতে পারেন।
কিন্তু হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি থাকার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলিও আপনার জানা উচিত, যেমন:
- এটি আপনাকে মানসিক শান্তি দেয়।
- আপনি উন্নত চিকিৎসার সুবিধা পান, কারণ সব খরচ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি করে।
- যদি আপনার নিয়োগকর্তার তরফ থেকে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স হিসাবে আপনি হেলথ ইন্স্যুরেন্স পান, তাহলে আপনি নিজের সঞ্চয় বাড়াতে পারেন।
- কিছু হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বিনামূল্যে বার্ষিক হেলথ চেক-আপের সুবিধা দেয়।
- এটি কঠিন সময়ে আপনার সঞ্চয় হিসাবে কাজ করে। আপনাকে প্রিমিয়াম দিতে হবে, কিন্তু আপনি আর্থিকভাবে যে-পরিমাণ সাহায্য পাবেন, তা অনেক বেশি।
- ট্যাক্সের সুবিধা: হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি কিনলে আপনি আয়করের ধারা 80D-এর অধীনে করে সুবিধা পাবেন।
আপনি নিজের হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান চূড়ান্ত করার আগে চটজলদি কয়েকটি টিপস দেখে নিন
বাজারে প্রচুর হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থাকার ফলে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী একটি হেলথ ইন্স্যুরেন্স প্ল্যান বেছে নেওয়া বেশ কঠিন হতে পারে। এখানে আমরা একটি ছোট চেকলিস্ট দিলাম, যেটি আপনার ইন্স্যুরেন্স প্রোডাক্ট চূড়ান্ত করার আগে দেখে নেবেন।
- বেছে নেওয়া ইন্স্যুরেন্সের অর্থ পরিমাণ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে নেবেন। সেটি আপনার ও আপনার পরিবারের সদস্যদের জন্য যথেষ্ট কিনা দেখে নেবেন।
- আপনার উপর নির্ভরশীল বাবা-মার জন্য ইন্স্যুরেন্সের অর্থ পরিমাণের সঠিক সীমা ঠিক করবেন।
- ন্যূনতম অপেক্ষার সময়কাল-সহ প্ল্যান বেছে নেবেন।
- সর্বাধিক বয়স পর্যন্ত রিনিউ করার সুবিধা আছে কিনা দেখে নেবেন।
- এমন কোম্পানি থেকে হেলথ ইন্স্যুরেন্স পলিসি কিনবেন, যেটির দ্রুত ক্লেম সেটলমেন্টের হার আছে।
- এমন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বেছে নেবেন, যেটির তালিকায় হাসপাতালের নেটওয়ার্ক সবচেয়ে বেশি আছে।